“দুর হবে ভাতের কষ্ট”
রাজবাড়ীতে ট্রান্সজেন্ডারদের রোপনকৃত সোনালী ধানে স্বপ্নপূরন রাজবাড়ী / 
অন্যের কাছে হাত পেতে নয় ! নয় ভিক্ষাবৃত্তি ! ঘুরে দারানোর চেষ্টায় পুরুষের সাথে সমান তালে কাজ করে সোনালী ধান রোপন, যত্ন ও কেটে ঘরে তুলছেন রাজবাড়ীর ২৬ জন তৃতীয় লীঙ্গের মানুষ বা ট্রান্সজেন্ডার। এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এলাকাবাসী। আর সমাজসেবা কর্মকর্তা বলছেন, ধান রোপন করে তাদের খাদ্য তারা জোগার করছে এতেই বোঝা যায় ওরাও পরিশ্রম করে সফলতা আনতে পারে। পাশাপাশি মূলস্রোত ধারায় ফিরিয়ে আনতে রাজবাড়ীতে ট্রান্সজেন্ডারদের দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রশিক্ষন।
জানাগেছে, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ায় পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ২৬ জন তৃতীয় লীঙ্গের মানুষের বাস করেন। পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এসকল মানুষ রেলস্টেশন, ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাটে অন্যের কাছে হাত পেতে জীবন পার করলেও এবার তারা স্বপ্ন দেখেছে কিছু একটা করার। ২৬ জনের জমানো টাকায় গুরু মা মাহিয়া মাহির পরামর্শে গোয়ালন্দ উপজেলার জুরান মোল্লার পাড়া এলাকায় সাড়ে তিন বিঘা জমি ভারা (কট) নিয়ে রোপন করেছেন ধান। আবার সেই ধানের সকল প্রকার যত্ন এমনকি কেটে ঘরে তোলার কাজও করছেন তারা নীজেরাই। সাড়ে তিন বিঘা জমিতে যে ধান তারা পাবেন এতে বছরের বেশির ভাগ সময় চালের জোগান দিবে বলছেন এই কাজের উদ্যোক্তা।
দৌলতদিয়ার তৃতীয় লীঙ্গের বাসিন্দাদের গুরু মাহিয়া মাহি বলেন, আমরা সব সময়ই ঘৃনার পাত্র। আমাদের পরিবার সমাজ বেশির ভাগ মানুষ ভালো ভাবে দেখে না। আর ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হাবিবুর রহমানের মতো দুই একজন ভালো মানুষও আছে যারা আমাদের কথা ভাবে। সমাজের আর দশ জন মানুষের মতো আমরাও মানুষ। ভাতের কষ্ট দুর করতে আমরা নীজেরা টাকা জমিয়ে ৩২ হাজার টাকা দিয়ে সাড়ে ৩ বিঘা জমি এক বছরের জন্য কট (ভারা) নিয়ে নীজেরাই ধান উৎপাদন করেছি। এখান থেকে অন্তত ৮৫ মন ধান আমরা পাবো। যা দিয়ে ২৬ টি মানুষের অন্তত ৮ মাসের ভাতের কষ্ট দুর হবে।
মাহি আরো বলেন, গোয়ালন্দ উপজেলায় অনেক খাস জমি আছে আমরা এক টুকরো জমির জন্য সরকারী সকল কার্যালয়ে ছোটাছুটি করেছি। কেউ কোন সারা দেয়নি। এমনকি আশ্রয়ন প্রকল্পেও আমাদের ঠাই মিলেনি। থাকি ভারা বাসায় খুপরি ঘরে একত্রে সুখেই আছি আমরা।
তৃতীয় লীগের অন্য বাসিন্দা স্বপ্না বলেন, মানুষের কাছে হাত পেতে টাকা চাইলে তারা খারাপভাবে দেখে। বলে কটু কথা। কিন্তুু মানুষ হিসেবে আমরাও সকল কাজ করতে পারি। কষ্ট করে আমরা যে ধান ফলিয়েছি এই ধান ঘরে তোলার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বপ্ন পুরন হবে, তাই চাষ করার মতো একটু জমি বা মানুষ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবী একটু বাসস্থান পেলে উন্নয়নের মাইল ফলকে ভুমিকা রাখতে পারবো আমরাও।
ধান রোনকারী তৃতীয় লীঙ্গের বাসিন্দা একাময়ী বলেন, সব ধরনের কাজ পারি আমরা। আমরা হাস ভেরা পালন করি তাও ভারা বাসায়। আমরা ধান চাষকরে ধান ফলাতে পারি। মানুষের একটু সহমর্মিতা, একটু ভালোবাসা পেলে আমরাও অসাধ্যকে সাধ্য করতে পারি।
তৃতীয় লীঙ্গের বাসিন্দাদের মাঠে কাজ করা ও ধান রোপনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এলাকাবাসী। তাদের পাশে থাকার অঙ্গিকারও করেছেন অনেকে।
গোয়ালন্দ উপজেলার জুরান মোল্লার গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, তারা যে কাজটি করছে এটি কোনভাবেই ছোট নয়। চালের যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে তারা তাদের চালের জোগান নীজেরা দিতে পারলে এটি অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। তাদের মাঠে ধান কাটা দেখতে আমরাও গিয়েছিলাম। মনে হয়েছে তারা কোন অংশেই কম নয় ? ব্যক্তিগতভাবে এ সকল বাসিন্দাদে সহযোগিতা করার কথা বলেন তিনি।
অপর বাসিন্দা মাওলানা ইসলাম মিয়া বলেন, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো প্রয়োজন। ওদের সাথে মানুষ শুধু খারাপ ব্যাবহার করে মানুষ হিসেবে ওদের সহযোগিতা করা উচিৎ, আমরা তাই করবো। এলাকাবাসী হিসেবে ওদের বিপদে আপদে সব সময় পাশে দাড়াবো আমরা।
আর সমাজ সেবা অধিদপ্তর রাজবাড়ীর উপ পরিচালক রুবাইয়াত মোঃ ফেরদৌস বলেন, নীজেদের ভাগ্যের উন্নয়নে চেষ্টা করা, নীজেরা স্বাবলম্বি হওয়ার জন্য ফসল উৎপাদন করছে তাদের অবশ্যই ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ। আমি ব্যাক্তিগতভাবে তাদের ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি রাজবাড়ী জেলার তৃতীয় লীঙ্গের বাসিন্দাদের মুলস্রোত ধারায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে। যেমন সেলাই প্রশিক্ষন, কম্পিউটার প্রশিক্ষন, বয়স্ক ও বৃদ্ধদের ভাতার আওতায় আনা। এমনকি দৌলতদিয়ার ট্রান্সজেন্ডাররা যদি চারজন করে গ্রুপ তৈরি করে আমাদের কাছে আবেদন করে তাদের স্বাবলম্বি করার জন্য অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করা হবে।