Opu Hasnat

আজ ১৯ মার্চ মঙ্গলবার ২০২৪,

মানবপ্রেমী রুকসানা কামার : এক বিরল সমাজসেবীর প্রতিকৃতি সাক্ষাৎকার

মানবপ্রেমী রুকসানা কামার : এক বিরল সমাজসেবীর প্রতিকৃতি

বাবার বাড়ি গোপালগঞ্জ, স্বামীর বাড়ি ফরিদপুর। বাবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। লোহাগাড়া কলেজ বায়োলজি বিভাগের প্রফেসর ছিলেন তিনি, মা গৃহিনী। সাত বোন দুই ভাই। বোনদের মধ্যে তিনি বড়। স্বামী ব্যবসায়ী, তাদের ছেলেমেয়ে তিনটি। একটি ছেলে দত্তক নিয়েছেন। এ ছেলেটি নিয়ে এ দম্পতির এখন সন্তান সংখ্যা চার। তিন ছেলে এক মেয়ে। তিনি একজন সরকারী চাকরিজীবী। কিশোরী বেলা থেকেই মানুষের পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি একসময় আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর সংবেদনশীলতা দিয়ে কাজ করে যাবেন তা হয়তো তার পরিবার থেকে বুঝেও থাকতে পারেন। বাবা সে কারণেই মেয়েটির এ ধরনের সেবামূলক কাজের উৎসাহ দিতেন মৌন সম্মতি দিয়ে। বাবার এধরনের আশ্রয় প্রশ্রয়ে স্কুল জীবনেই সেবাময়ী হিসেবে একধরনের সুনাম অর্জন করতে পেরেছিলেন। মেয়েটির নাম রুকসানা কামার। আজ যিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল একজন সেবাপরায়ণ নারী। যিনি জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছেন সমাজসেবা তথা মানবসেবাকে। মানবপ্রেমী রুকসানা কামারের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ওমর আলী।

 

আপনার তিনটি সন্তান থাকতেও আপনি একটি দত্তক পুত্র নিলেন কেন ?

আমিতো ছোট বেলা থেকেই সোস্যালওয়ার্ক করি। চাকরি করি ঠিকই কিন্তু আমার আসল কাজ জনসেবা করা। আমার মনে হয়, চাকরি করি বেতন নেই গভর্নমেন্টের, একটা দায়িত্ব আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে দায়িত্ব আমি মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় এসেছি সমাজের জন্য শোষিত বঞ্চিত মানুষের জন্য সে যে ধর্মেরই হোক না কেন মানুষের জন্য কিছু করা উচিৎ। এই চিন্তা থেকেই আমি ক্লাশ সেভেন থেকে সামাজিক কাজ করে থাকি। ওই বয়সে একটি পাগলিকে সেবা দিয়ে তাকে মোটামুটি সুস্থ করে তোলার মাধ্যমে শুরু হয় আমার সোস্যালওয়ার্ক। তো এটা থেকেই আমার শুরু। ২০১২ সালের একটা ঘটনা আপনারা দেখেছেন, সব মিডিয়ায় মোটামুটি কভারেজ পেয়েছিলো প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় আপনারা দেখেছেন যে, একটি ছোট ছেলের দু’হাত কেটে দেয় তার সৎবাবা ভিক্ষাবৃত্তির জন্যে। ওই বাচ্চাটিকে আমি ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা করাই এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাই। তো ওখানে চিকিৎসা শেষ করার পর অনেক ঝড় ঝঞ্ঝার পর ওকে একটি সংগঠনের সহযোগিতায় আমেরিকা নিয়ে যাই কৃত্রিম হাত লাগানোর জন্য। ওকে আমেরিকার হাসাপাতালে চিকিৎসা করিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসি। আমি যতদূর জানতে পেরেছি ওর মাও ভিক্ষবৃত্তি চক্রের সঙ্গে জড়িত। ওই বাচ্চাকে যদি ওর মায়ের কাছে দিয়ে দেই তাহলে হাত খুলে ফেলে ওই বাচ্চাকে দিয়ে আবার ভিক্ষা করাবে। আগেও এরকম করিয়েছে সে। এটা প্রমাণিত, কারণ এর ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে। বাচ্চাটির লাইফ যাতে নষ্ট না হয়, আমি চাচ্ছি আমার নিজের বাচ্চার মতোই ও সুনাগরিক হয়ে উঠুক। সে কারণেই বাচ্চাটিকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি। এবং আদালতের মাধ্যমেই অনুমতি নিয়ে আমার কাছে রেখেছি। ও এখন স্কুলে পড়ে। আমার নিজের সন্তানের মতোই ওকে নিয়ে অনুষ্ঠানাদি করে থাকি। ওর বয়স এখন আট বছর। ওর নাম হচ্ছে রবিউল ইসলাম শান্ত।

আপনার কাছেতো অবশ্যই প্রমাণ আছে? ওর জন্ম কোথায়, ওর মা-বাবার নাম কী?

বাচ্চাটি আমি যখন পেলাম তখনতো ওর অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ওকে চেনা যেত না যে ও একটা মানুষ না অন্য কিছু! যখন ওর চেতন ফিরেছে তখন ও ভালো করে কিছু বলতে পারেনি। তো ওই বাচ্চটিকে যখন আমি ঢাকা মেডিকেলে রাখলাম, আমাকে অনেকেই হুমকি দিলো। যারা এই দুষ্কর্মের সাথে জড়িত ছিলো তারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলো। তারপর বাচ্চাটা চুরি হবার আশঙ্কা ছিলো। যখন আমি বুঝতে পারলাম বাচ্চাটিকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে, আমাকে এবং বাচ্চাটিকে মেরে ফেলারও চেষ্টা করতে পারে। তখন আমি প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছিলাম। এবং প্রশাসনের লোক বিশেষ করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের এসআইদের সাথে করে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে এলাম পঙ্গুতে। পঙ্গুতে ভর্তি হবার পর দিন থেকেই বাচ্চাটি নিজের বাবার নাম ও অন্যান্য কিছু বলতে পারলো। ওর বাড়ি হচ্ছে নোয়াখালী। ও নিজেই বলেছে ওর সৎবাবা ওর হাত দু’টো কেটেছে। ওরা থাকতো কড়াইল বস্তিতে। যখন এই প্রতিবেদন এনটিভিতে প্রচারিত হলো প্রশাসন থেকে আমার কাছে একটি ফোন এসেছিলো- বাচ্চাটিকে নিয়ে ওরা স্পটে যেতে চায়, আমি বললাম ঠিক আছে নিয়ে যান। তখন পঙ্গু হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডবয়সহ ওই বাচ্চাটিকে নিয়ে স্পটে যায় রাতে বনানী থানার আও সাহেবের নেতৃত্বে। ওখানে যাওয়ার পর বাচ্চাটি ওর মাকে দেখাতে পেরেছে। ওরা যেখানে থাকতো সেটাও বাচ্চাটি দেখাতে পেরেছে।

ওর বাবা, যে হাত কেটেছিল তাকে পেয়েছিল ?

হ্যাঁ। বাচ্চাটিতো নিজেই বলেছে ওর সৎবাবা। মানে ওর মায়ের দ্বিতীয় যে বিয়ে হয়েছে ওই স্বামিটি ছেলেটির দুই হাত কেটে দিয়েছে।

সমাজসেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার কারণ কি ?

সমাজসেবার মতো এমন আনন্দের জিনিস আর আছে নাকি ? একটা মানুষের জন্য কিছু করতে পারা- এটাতো টাকা দিয়ে হয় না। যে এটি উপভোগ করেছে সেই ভালো বলতে পারবে। এটার মূল্য কেউ দিতে পারবে না, এটা অমূল্য। এই মূল্যবোধ থেকেই আমি সমাজসেবা করছি। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশেতো অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। যে কোন একটা ভালো কাজ করলে তার যে আত্মতৃপ্তি এটা সারা জীবনের সঞ্চয়ের চেয়েও অনেক বেশী আনন্দদায়ক। ওই আনন্দটাতো মিস করতে চাই না আমি। আমি যতদিন বাঁচবো ওই আনন্দটা নিতে থাকব। যতই প্রতিকূলতা আসুক, বাধা আসুক, মোকাবেলা করে আমি মানব সেবা করে যাবো।

এখন ওই মামলাটির কি অবস্থা ? কি পর্যায়ে আছে ? ছেলেটি তো আপনার কাছেই আছে-

মামলা চলছে। গত মে মাসের ৬ তারিখে সাক্ষী হবার কথা ছিলো। ওর মা গিয়েছে, সাক্ষী দেয়ার সময় সে উল্টাপাল্টা কথা বলে। উনি নিজেই মামলা করেছে আর নিজে ঠিকমতো বলতে পারছে না। মামলাতো হালকা হয়ে যাবে, আসামী খালাস পেয়ে যাবে। ও ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করছে। পরবর্তী তারিখ এখনও জানতে পারিনি। যে কোন কাজে যদি প্রশাসন বলেন আর সমাজ বলেন- এরা যদি উৎসাহ দেয় বা পাশে দাড়ায়, শুধুমাত্র উৎসাহ দেয় তাহলে আমাদের মতো কর্মীদের কাজের গতি দ্বিগুন বেড়ে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজ ভালো দিকটাকে সহজে গ্রহন করে না। এটাই হচ্ছে মুশকিল। মন্দটাকে যতো সহজে গ্রহন করে ভালোটাকে সেভাবে করে না। আমি ২০০৪ সালে একটি বাচ্চা মেয়ের ওপেন হার্ট সার্জারি করিয়ে দিলাম। বাচ্চাটির মা-বাবা কৃষক্ বাচ্চটির বয়স তখন ৭ বছর ছিল। তাকে আমি এখন লেখা পড়া করাই। যখন শুনলাম ও রোগে ভুগছে- কেউ ওকে চিকিৎসা করাতে পারছে না তো ওকে নিয়ে আসলাম হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এ। সেখানে দেখি বিরাট সিরিয়াল। ডাক্তার বলছে আবার দ্রুত ওর ওপেন হার্ট সার্জারী করাতে হবে। না করলে যে কোনও সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আমাকে ডাক্তার বললো ২১ দিনের ভেতর করাতে হবে। ওকে আমি নিয়ে গেলাম হার্ট ফাউন্ডেশনে। ওরা আমাকে প্যাকেজ বললো এক লাখ সাতষট্টি হাজার টাকা। এটি ২০০৪ সালের ঘটনা। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বললাম তুমি ২০ হাজার টাকা দাও আর আমি ২০ হাজার এই চল্লিশ হাজার। আর দেখি মানুষের কাছ থেকে কিছু কিছু নিয়ে করাই। এর জন্য পত্রিকায় আমি ছোট একটি বিজ্ঞাপন দিলাম। আমার মোবাইল নম্বর দেয়া ছিল। এরপর দেখি বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার কাছে বিভিন্ন রকম ফোন আসতে শুরু করলো। কেই আমাকে ফোন করে বলছে আমরা সাহায্য করবো আমাদের মোবাইলে ২০ হাজার টাকা ফ্রেক্সি করে দিন- (এটা একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান)। এটা রেজিস্ট্রেশন ফি। কেউ আর্মি অফিসার পরিচয় দিয়ে আমাকে ধমক দিচ্ছে, “সরকারি চাকরি করে এসব বরবি তো তোর চাকরি শেষ” এরকম অবস্থা আরকি। কেউ আবার বলছে যে টাকা উঠবে তার ফিফটি পার্সেন্ট দিতে হবে। মানে কি যে অবস্থা! তখন তো বয়স আমার আরো কম সবাইকে খুব স্ট্রংলি উত্তর দিলাম। এরপর বিজিএমইএ-এর বর্তমান সভাপতি আতিক স্যার। তিনি আমাকে চিনতেন না জানতেন না। জানতে পারলাম উনি লায়নিজম করেন, মানুষকে বেশ সাহায্য  সহযোগিতা করেন। তখন রমজান মাস। তার কাছে গিয়ে বাচ্চাটির ছবি দেখালাম। তিনি বললেন, আমি তোমাকে এই অ্যামাউন্টটি দিয়ে দেই, তোমার চলবে? আমি বললাম, আমার বাচ্চাটিকে অপারেশন করাতে হবে এই মুহূর্তে আপনি আমাকে যেটিই দিবেন, আমার খুবই কাজে লাগবে। পরে তিনি আমাকে ৩০ হাজার টাকার একটি চেক দিয়ে দিলেন। আমি বললাম, কি ব্যাপার উনি কি ভুল করে এত টাকার চেক দিয়ে দিলেন নাকি! অ্যাকাউন্টস অফিসারকে বললাম, আপনি ভাল করে গিয়ে দেখেন, ভুল করছেন বোধ হয়। তার পর উনি বললেন, না এটিই দিয়েছেন আপনাকে। আমি বললাম, স্যার আপনি আমাকে বিশ্বাস করে এতগুলো টাকা দিলেন? তিনি বললেন, সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না, আবার সবাইকে অবিশ্বাসও করা যায় না। আমি স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ।

অপারেশনের সময় তিনি লোক পাঠিয়েছিলেন। অপারেশনে আমার ৫ হাজার টাকা শর্ট পরেছিল। হার্ট ফাউন্ডেশনে অপারেশনটি করিয়েছিলাম। এখানে ১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। ৫ হাজার টাকা বাকি ছিল বলে হার্ট ফাউন্ডেশেন অপারেশন করবে না বলে জানিয়েদিয়েছিল। এদিকে আমি এসেছি শান্তিনগরে সাদা রক্ত নিবার জন্য। ওর মা-বাবা গ্রামের সহজ-সরল কৃষক ওরা কিছু বোঝে না। ৫ হাজার টাকা ছিল না বলে অপারেশন করবে না বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো। জানেন না আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। পরে আমার হাসব্যান্ডকে ফোনে বলেছিলাম যেভাবে পারো আমার জন্য ৫ হাজার টাকা পাঠাও। তখন মোবাইল ফোনে বিকাশ ব্যবস্থা ছিল না। এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে পাঠাবে ফরিদপুর থেকে। তিনি বললেন আমি বাসে আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি টাকা দিয়ে, তুমি ওদের বলো অপারেশন করতে, টাকা বিকেলে পরিশোধ করবো। একথা বলার পরও ওরা অপারেশন করতে রাজি হয়নি। এরপর ফরিদপুর জুট ফাইবারের আমাদের চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের ভাই এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান চৌধুরী খালেদ ইবনে ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের সাথে কথা বলি। বাচ্চু ভাই আগে দিয়েছিল ৫ হাজার টাকা, অবশ্য ওনার ছেলে দিয়েছির ২০ হাজার টাকা। আমাকে বাচ্চু ভাই ফোন দিচ্ছিলেন- তোমার মেয়ে কি ওটিতে উঠেছে নাকি ? আমিতো কান্নাকাটি করছি, বললাম, ওপারেশন ছিল সকাল ৮টায় এখন বেলা আড়াই টা বাজে, এখনও ওরা ওটিতে নেয়নি মাত্র ৫ হাজার টাকা বাকি থাকার জন্য। তিনি বললেন, তাহলে তুমি একটি বার ফোন করতা, আমি পাঠিয়ে দিতাম। তারপর দেখি বাচ্চু ভাই ৫ হাজার টাকা ও এক প্যাকেট অরেঞ্জ পাঠিয়ে দিয়েছেন। বিজিএমইএ এর সভাপতি আতিক ভাই লোক পাঠিয়েছিলেন, ফোন দিয়েছিলেন। তিনি বলেন কি ব্যাপার এখনও ওটি হয়নি কেন ? আমি তাকে বাস্তব অবস্থাটা জানালাম। স্যার আমাকে একটু বকাই দিলেন,- আমি বলেছিলাম না এ মেয়ের অপারেশনে আরও টাকা লাগে আমি দেব, আমার কাছে চাইবে তুমি। তা নাকরে কান্নাকাটি করছো কেন তুমি ? মাত্র ৫ হাজার টাকার বাকিতে ওটিতে ওঠায়নি বলে ওদেরকেও তিরস্কার করেছিলেন তিনি। অবশেষে অপারেশন হলো। ওই মেয়েটি এখন ওর স্কুলের ফার্ষ্ট গার্লস, ওর বোনও খুব ভালো স্টুডেন্ট। ওরা দুই বোন। দুজনকেই আমি নিজ খরচে লেখা পড়া করাচ্ছি।

আপনার কাজের ধারায় আর কি কি করেছেন আপনি ?

এ ধরনের অনেক কাজ করেছি আমি। একটি মেয়ের পায়ে সতেরটি টিউমার হয়েছিল। ওই মেয়েকে এনে পঙ্গুতে অপারেশন করিয়েছি আমি। এখন ওর কৃত্রিম পা লাগাতে হবে।

এই যে সেবা কর্ম গুলো করে যাচ্ছেন আপনি, কিভাবে এদেরকে খুঁজে বের করেন?

আমার কাছে এরা আসে। জানিনা এরা কিভাবে সন্ধান পায়। শুক্রবার শনিবার আমি ঘুমিয়ে থাকি, ভোর বেলা থেকেই লোকজন এসে আমার বারান্দায় অপেক্ষা করতে থাকে। আমি খুশি হই, আমি আল্লাহর কাছে বলি হাজার শুকুর, আমি হয়তো খুঁজে খুঁজে সেভাবে পেতাম না। ওরা যেভাবে খোঁজ নিয়ে আমার কাছে আসে আমিও সেভাবে সহযোগিতা করি। গোপালগঞ্জের কোন এলাকায় আমি সেভাবে আমি চিনিনা, সেখান থেকে এক মহিলা সেদিন এসেছে তার স্বামী তাকে অত্যাচার করেছে। সে মেয়েকে ঢাকায় এনে রেখে আইনগত সহযোগিতা দিয়েছি। প্রথমে থানায় কেস নিতে চায়নি চাপ প্রয়োগ করে তাদের বাধ্য করেছি। এটা মিরপুর ২ এ হয়েছে।

আপনি রোগি নিয়ে কোন হাসপাতালের ইমাজেন্সিতে যান তখন কেমন সহযোগিতা পান ?

সহযোগিতার কথা আর কি বলবো গাফলতিই করে থাকে প্রথমত। প্রথমেইতো পরিচয় দিতে পারিনা। পরিচয় না দিলে প্রতিটি জায়গায় এমন আচরন করে যা ভাবা যায়না। রোগীর সাথে দুর্বব্যহার করে। রোগীর আত্মীয়স্বজনদের সাথে দুর্বব্যাবহার করে। যেদিন একটু কমদামি পোষাক পড়ে গেছি ভাই সেদির আর বলার কিছু নাই, কাউকেই ডেকে কাছে পাইনা, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেকটি লোক অবহেলার চোখে দেখে। তারপর পরিচয় দেয়ার পর, দ:খজনক হলেও সত্যি একটু ধমক পর্যন্ত দিতে হয় চিকিৎসার জন্য। একবার পঙ্গুতে প্রথমে আমার একটি বাচ্চাকে ভর্তি নিতে চায়নি খুব দু:খ পাচ্ছিলাম এমন একটি বাচ্চা অথচ ভর্তি নিতে গড়িমসি করছে। যেই ডিউটি অফিসারকে ধমক দিলাম, তখন রেজবি সাহেব ছিলেন পরিচালক, আমি অফিসারকে বললাম যান পরিচালককে বলুন আমার নাম রোকসানা আমি এ বাচ্চাটিকে ভর্তির জন্য প্রয়োজনে মাস্তানি করবো। পরে অবশ্য ভর্তি করে নিয়েছিল। ব্যান্ডেজ খুলেই দেখে ওর ইনফ্যাক্সন হয়েছে এবং সাথে সাথেই ওকে ওটি করাতে হয়েছে। পায়ের এক অংশ থেকে মাংস কেটে গ্রাফটিং করতে হয়েছে, তখন ব্লাড দিতে হয়েছিল। অথচ দেখেন এই বাচ্চাটিকে তারা ভর্তি করতে চাচ্ছিলনা।

এ কারনেই কি ডাক্তারদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে ? আপনি কি মনে করেন ?

আপনারাইতো ভালো জানেন ভাই। কিছু কিছু ডাক্তার, নার্স ও আয়ার ব্যবহার এতখারাপ, তাদের এ পেশায় আসাই উচিত হয়নি।

আপনি কোথায় চাকরি করেন ?

আমি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত আছি বাংলাদেশ ইকোনোমিকস জোন-এ।

আপনার সামাজিক কর্মকান্ডের কথা শুনে যে কেউ সন্তুষ্ট হবে, অনুপ্রানিত হবে, তার ভেতরও মনুষত্ব জেগে উঠবে- তো লেখা-পড়ার কোন পর্যায়ে আপনি সমাজ সেবায় যুক্ত হন ?

আমি আমার সেবাকর্ম শুরু করেছি ক্লাস সেভেন থেকেই। আমাদের বাড়ির পাশে এক পাগলি ছিল। গোপালগঞ্জের রামদিয়ায়। ওর বাবা এবং ওরা কয়েকটা বোন সবাই অ্যাবনরমাল ছিলো। ওই মেয়েটিকে আমি অনেকদিন দেখিনা, এবার বাড়ি গিয়েও খুঁজেছি তাকে পাইনি। আমি খুব ফিল করি তাকে। কারন আমার জীবনে সেবাকর্ম ওকে দিয়েই শুরু হয়েছে। ওই বয়সেতো আমার কাছে টাকা পয়সা ছিলো না। তো দাদার পেনসনের টাকা চুরি করে ওকে দিতাম, দাদির শাড়ি চুরি করে ওকে দিতাম। ওকে আমি পড়াতামও। মা যখন ঘরে থাকতো না এক ফাকে কিছু চাল নিয়ে ওকে দিতাম। একটি আশ্রয় কেন্দ্রে রেখেছিলাম ওকে। ওখানে গিয়ে কিছু কিছু খাবার দাবার কিনে দিয়ে আসতাম। আবার আব্বার কাছ থেকে কিছু টিফিনের টাকা নিয়ে ওকে শ্যাম্পু, সাবান, তেল কিনে দিয়ে আসতাম। ওকে মাঝে মাঝে নিজ হাতে গোসল করিয়েও দিতাম। ওর বয়স তখন ১৬/১৭ বছর হবে। সবচেয়ে ট্রাজেডি হলো সে প্রতিবন্ধি হলেও প্রেগন্যান্ট ছিলো। এটা আমাকে খুব কষ্ট দিতো যে, সমাজে কতো খারাপ মানুষ আছে। মেয়েটিতো এতে করে মারাও যেতে পারে তার বাচ্চাটিও মারা যেতে পারে। জানতে পেরেছি আশ্রয়কেন্দ্রের কোন এক পুলিশ এ দুর্ঘটনাটি ঘটিয়ে ছিলো। এমন দু:খজনক ঘটনা পাগলির বাচ্চাটি ভুমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে ঐ দুস্কৃতিকারিরা বাচ্চাটিকে মেরে ফেলে। আমি তখন বাসায় ছিলাম। আমি তখন রামদিয়া গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী। তখনই আমি রেডক্রিসেন্টের সদস্যও ছিলাম। আমাকে উপজেলা পর্যায়ে রেডক্রিসেন্টের সভাপতিও বানানো হয়েছিল। অথচ আমি তখন মাত্র সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী।

আপনি কি স্কাউটস-এর ও সদস্য ছিলেন ?

তখন আমাদের ওখানে স্কাউটস তেমন একটা ছিল না। তবে রেডক্রিসেন্ট থেকে ভাইয়েরা যেত বিভিন্ন প্রোগ্রামে। আমার স্কুলের শিক্ষকরা বলতেন আমাদের স্কুলে একজনই আছে যে এসব কর্মকান্ডে সবার আগে থাকে সে হচ্ছে রুকসানা। এ কারনেই সবাই আমাকে এক নামে চিনতো।

আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য টাইমটাচনিউজ-এর পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার বিশাল কর্ম জগত। একদিনে কথা বলে সব শেষ করা যাবে না। আশা করি আবার কোন এক সময় আপনার মুখোমুখি হয়ে আপনার সেবামূলক সর্মকান্ড সম্পর্কে আরও অবগত হবো এবং পাঠকদের সামনে তুলে ধরবো যাতে করে তারাও সমাজসেবায় অনুপ্রানিত হয়। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি এবং আপনার সেবামূলক কাজ আরও ব্যাপ্তিময় হোক এই কামনা।

ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে এবং টাইমটাচনিউজ পরিবারকে ধন্যবাদ।

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ওমর আলী, সাংবাদিক-সংগঠক // টাইমটাচনিউজ ডটকম