আর কতদূর যেতে হবে নাজনীনকে ! নীলফামারী / 
ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয়। মায়ের আদর স্নেহে বেড়ে উঠে সব সন্তানই। হোক সে মেয়ে অথবা ছেলে সন্তান। মায়ের কাছে সবাই সমান। সমাজে সেই মায়েদের আর এক প্রতিষ্ঠিত নাম রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে নারী। নারীর আন্দোলন যখন জোট বাঁধে তখন বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসে। শতাব্দী জুড়ে নারীর আন্দোলন মাইলফলক ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তেভাগা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ বিজয়ের পঞ্চাশে সকল উন্নয়নে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। সরেজমিনে ঘুরে এসে এক নারীর জীবনের বিস্তর গল্প থেকে সামান্য টুকু কলমে ধারণ করলাম।
নারীটি যখন শিশু ছিল তখন তার স্নেহময়ী মা ছকিনা খাতুন পাড়ার লোকজনের পরনের কাপড় সেলাই করে সংসার চালাত। ছকিনা খাতুন তার আদরের প্রথম কন্যাটিকে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। খেয়ে-না খেয়ে কন্যাটি বড় হতে লাগল। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষগণের সহযোগীতায় উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়ালেখার খরচ চলতে থাকে তার। এরই মধ্যে কন্যা রমাছকিনার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ে। গরিবের একবেলা খাবার জোটেনা তার আবার চিকিৎসা ব্যায়ভার কোনোভাবেই সম্ভব ছিলনা। কন্যাটি এসএসসি পরীক্ষা দেবার আগেই তার মা জননী ছকিনা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকে গমণ করেন। মায়ের এ অকাল মৃত্যুতে কন্যাটির তথা সৈয়দপুর উপজেলার বাঁশবাড়ি মহল্লার নাজনীন বেগমের জীবনে অন্ধকার নেমে আসল। ছোট তিনটি ভাই-বোন আর অসুস্থ বেকার পিতাকে নিয়ে কোথায় যাবে? কীভাবে সংসারের খরচ বহন করবে এসব ভাবনা থেকে সে সৈয়দপুরের নারী সাংবাদিক শানু’র সহযোগীতায় স্থানীয় ম্যারীগোল্ড স্কুলে একটি চাকুরী নেয়। শত কষ্টের মাঝে ও চাকুরীর পাশাপাশি স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকগণের সহযোগীতায় লেখা-পড়া চালিয়ে যায়। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে সেনাবাহিনীর অধিনে নীলফামারীর বিভিন্ন থানায় নানা সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ শুরু করে। সামান্যতম আয় দিয়ে সংসার খরচ এবং ছোট ভাই-বোনদের পড়াশুনার খরচ মেটায়। এরই মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক নাজনীন চাকুরি ছেড়ে দিয়ে গ্রাজুয়েশন সমাপ্ত করে। কিন্তু সংসারের খরচ মেটানো আবারও কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ালে। কিন্তু তার কাজের দক্ষতার জন্য পূণরায় সে ২০১৭ সালে ঢাকার মীরপুর নির্বাচন অফিসে স্মাটকার্ড তৈরি এবং বিতরণের আনুসাঙ্গিক অস্থায়ী কাজে নিয়োগ পায়। সেখানে মোট ৩৩জন একাজে নিয়োগ পায়। কর্তৃপক্ষ ৩৩জনকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে দুটি দলে বিভক্ত করে দেন। তখন থেকে শুরু হয় নাজনীনের জীবনে কালো অধ্যায়ের সুচনা। নাজনীনের টিমে শরিফুজ্জামান শাহেদ খান (বাবু) নামে তার এক সহকর্মী ছিল। শরিফুজ্জামান নাজনীনের সাথে ভালো সহকর্মী হওয়ার ফাঁদ পেতে তার বাড়ির ঠিকানা এবং পরিবারের সমস্ত খবরাখবর নিয়ে ফেলে। নাজনীনও সরল মনে তার পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার গল্প সহকর্মীকে বলে দেয়। এরপর থেকে নাজনীনের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে সহকর্মী শরিফুজ্জামান তার সাথে নানা ধরনের সহিংসতা অর্থাৎ তাকে অবলা নারী হিসেবে তার কাজের মাঝে উত্যক্তকর অশালীন কথাবার্তা, ইফটিজিন আচরণ, সুযোগ পেলেই গায়ে হাত দেয়া শুরু করে। এরপরেও তাকে শরিফুজ্জামান হুমকি দিত যদি কাউকে বলে তার বিষয়ে তবে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবে অন্য কোথাও। তার কুপ্রস্তাব নাজনীনের প্রতিদিনের পর দিন বেড়ে যাওয়া নাজনীন কিছুতেই সম্মতি না দেয়ায়, কখনও কখনও এমন হয়েছে, নাজনীন যখন কাজের ফাঁকে বাথরুমের উদ্দেশ্যে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করলে শরিফুজ্জামান শাহেদ খান (বাবু) তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে বাইরে থেকে বাথরুম আটকে দিত। পরে অনান্য সহকর্মীদের অনুরোধে খুলে দিত। টিমে বেশির ভাগ সহকর্মী নারী ছিল। শরিফুজ্জামান প্রভাবশালী হওয়ায় তারাও প্রচন্ড ভয় করত। সে অনান্য নারী কর্মীকেও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করত। দিনের পর দিন নাজনীন মানষিকভাবে হয়রানির শিকার হতে থাকে। কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরলেও তার মোবাইল এবং ম্যাসেন্জারে হুমকি, ভয়ভীতি, অশ্লীল কথা বার্তা, এমনকি ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত ম্যাসেজের মাধ্যমে পাঠাতে থাকে শরিফুজ্জামান। এতে করে নাজনীনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক শান্তি, র্শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় এবং সে মানষিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতে থাকে। এ প্রতিকুল অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য এবং নিজের জীবন এবং মান-সম্মান রক্ষার্থে বাধ্য হয়ে এই নারী তার টিম লিডার আব্দুর রাজ্জাককে সব খুলে জানালে তিনি শরিফুজ্জামানকে এসব নোংরা কাজ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করেন। কিছুদিন উত্যক্তকারী নিশ্চুপ ছিল। কিন্তু দিন পনেরো না যেতেই পূণরায় এ ধরণের নির্যাতন নাজনীনকে করা শুরু করে। এ সময় নাজনীন অবলা থেকে বেশ সাহসীহয়ে উঠে। সে উত্যক্তকারীর বড় ভাই শাহরিয়ার রহমান খান (শান্ত)-কে বিষয়টি জানালে শাহরিয়ার উল্টো নাজনীনকে চরিত্রহীন বলে তাড়িয়ে দেয়। এভাবে কোথাও বিচার না পাওয়ায় এবং এসব নির্যাতনের মাত্রা বেড়েযাওয়ায় নাজনীন মানষিকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ ১০০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করে তার চিকিৎসা করানো হয়। সে সময় নাজনীনের কর্মস্থল এবং ঘটনাস্থল নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ হওয়ায় সে এ থানায় একটি জিডি দায়ের করে। বিষয়টি কিশোরগঞ্জ নির্বাহী অফিসার মোঃ আবুল কালাম আজাদ আমলেনিয়ে উত্যক্তকারী শরিফুজ্জামানকে ডেকে সতর্ক করেন। এবং নাজনীনকে সাহসীকতার সাথে সতর্ক থাকতে বলেন। কিন্তু তৎকালীণ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো: আফতাব উদ্দীন নাজনীনকে একটি লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। এরপর কর্মকর্তাদের সহযোগীতায় জিডিটাপেনাল কোড ৫০৬ ধারায় ফেীজদারী মামলা হয়ে কোর্টে চলে যায়।
এরপর থেকে শরিফুজ্জামান শাহেদ খান (বাবু) এবং তার বড়ভাই শাহরিয়ার রহমান খান (শান্ত) ক্ষিপ্তহয়ে আবার নাজনীনকে প্রাণনাশের হুমকি ও গালি-গালাজ মোবাইলের মাধ্যমে করতে থাকে। সেই সাথে র্কোটে মামলা তুলে নেয়ার চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এমনকি নামে বেনামে সাংবাদিক সেজে নাজনীনকে ফোন কলে ব্যবসায়ী চরিত্রহীনা নারী বলে বাজে মন্তব্য করে এবং সংবাদপত্রে তাকে নিয়ে অশ্লীলভাবে সংবাদ ছাপা হবে বলেও হুমকি প্রদান করে। এমতবস্থায় নাজনীন নীলফামারীর সৈয়দপুর থানায় থানা কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালে উনি জিডি করার পরামর্শ দেন। এবার নাজনীন আরো সাহসী হয়ে উঠে এবং ওই কর্মকর্তাকে বলে, বর্তমানযুগটা তথ্য প্রযুক্তির। প্রযুক্তির নিত্য নতুন উদ্ভাবন প্রতিনিয়ত পাল্টে দিচ্ছে মানুষের জীবন ধারা। এই জীবন ধারায় একদিকে যেমন আসছে গতি অপরদিকে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার থামিয়ে দিয়ে চুরমার করে দিয়েছে আমার জীবনের সকল স্বপ্ন। অথচ আপনি শুধু জিডির কথাই বলছেন। নাজনীন আরো বলেন, কত জিডি করব আর কত কাল ক্ষেপন হবে। এমতবস্থায় নাজনীন বিকশিত নারী নেটওয়ার্কের সহযোগীতায় র্যাব- ১৩ ক্যাম্প যায় কিন্ত সেখানে কোনো প্রকার সহযোগীতা না পেয়ে ফিরে আসে। এরই মধ্যে উত্যক্তকারী দুই ভাই ফেসবুকে নাজনীনকে নিয়ে বাজে পোস্ট দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। সেই সাথে ম্যাসেন্জারে ন্যুড ছবি ও কু-প্রস্তাব পাঠায়। মানষিকভাবে নাজনীন পূণরায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং একটা সময় আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমতবস্থায় সাংবাদিক শানু’র সহযোগীতায় নাজনীন স্বাভাবীক অবস্থায় ফিরে এসে সাভার ক্যাম্প এর র্যাব ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে সমস্যার কথা জানিয়ে সাহায্য আবেদন করে। র্যাব- ৪, ঢাকা নাজনীনকে ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিয়ে সরাসরি অভিযোগ দায়ের করতে বলে। নাজনীন তার লিখিত অভিযোগ নিয়ে র্যাব-৪, ঢাকায় গেলে সেখানে এ এস পি সাজেদুল ইসলাম সজল, মেজর কামরুল ও সিও মোঃ মোজাম্মেল হক নাজনীনের ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে শোনেন এবং মামলা আমলে নেন। তদন্ত সাপেক্ষে ১নং বিবাদী শরিফুজ্জামান শাহেদ খান (বাবু)-কে র্যাব গ্রেপতার করে জেলহাজতে প্রেরণ করে। কিন্তু ২নং বিবাদী শাহরিয়ার রহমান খান (শান্ত) এখনও পলাতক রয়েছে। র্যাব কর্মকর্তা নাজনীনকে যথেষ্ট সাহস ও বেঁচে থাকার জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। এ সাহসে নাজনীন প্রাণশক্তি ফিরে পায়। বেঁচে থাকার স্পন্দনের সাথে স্বপ্নজাগে তার, কিন্তু ২নং বিবাদী এখনও পলাতক থাকায় মাঝে মধ্যেই বেনামি মোবাইল কল আসে আর নাজনীনকে হুমকি প্রদান করে। এ কারণে নাজনীনের চলা-ফেরার স্বাধীনতা হরণ হয়েছে। সে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে। বর্তমানে চাকুরি না থাকায় এলএলবি পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। মিথ্যে বানওয়াট ও অশ্লীল এসমস্ত বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় সমাজে অনেকেই নাজনীনকে ব্যবসায়ী নারী হিসেবে মন্তব্য করায় সামাজিক বিবাহ বন্ধনে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ডিগ্রী পাশ করেও আজ তাকে বাড়িতে বসে কাপড় সেলাই করে অসুস্থ বাবাকে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। আজ নাজনীনের একটিই চাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারায় সে ন্যায় বিচারের সাথে উত্যক্তকারীদের কঠিন শাস্তি। যাতে করে অন্য কোনো নারীকে আর কেউ কখনও সমাজে এমন হেয়-প্রতিপন্ন করার সাহস যেন না পায়।
পূণরায় সে আলোর পথ ধরে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। বাস্তবায়ন করতে চায় তার স্বপ্ন। কিন্তু নাজনীনকে একটি কথা বার বার ভাবিয়ে তুলছে একজন মানুষকে আর কত দূর যেতে হবে বিচার পাওয়ার জন্য। সেই মানুষটি যদি গঠনে, চলনে, বলনে একজন নারী হিসেবে গন্য হয়-----?